ঠিক ছিল, খাটিয়ায় বসে কথা হবে সুখদুঃখের। বৈঠকি মেজাজে গ্রামের গরিব চাষাভুষো মানুষের অভাব অভিযোগ শুনবেন রাহুল গাঁধী। বোঝাবেন, কংগ্রেসই গরিবের আসল বন্ধু। তাতে যদি উত্তরপ্রদেশে কপাল ফেরে কংগ্রেসের। এমনটাই ছকে দিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর।
কিন্তু খাটিয়া তোলার কথা ছিল কি? কিংবা ‘খাটিয়া খাড়ি’ করার? দু’টোর কোনওটাই শুভ নয়। কেউ মারা গেলেই একমাত্র সেটা করা হয়। উত্তরপ্রদেশে রাহুলের প্রথম খাট-সভার পরে কিন্তু খাটিয়া খাড়া করা, তোলা শুধু নয় তুলে নিয়ে দুদ্দাড় ছুট লাগালেন সভার মানুষ!
রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে দেওরিয়া থেকে রাহুল গাঁধী ‘মহাযাত্রা’ শুরু করেন আজ। তারই প্রথম সভা শেষ হলে শুরু হয়ে যায় খুল্লম-খুল্লা খাটিয়া লুঠ! দেখেশুনে বিদ্রুপের হাসি বিজেপি নেতাদের মুখে। বেজায় বিড়ম্বনায় কংগ্রেস।
‘চায়ে-পে চর্চা’র আয়োজন করে নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর। তাঁরই পরিকল্পনা মতো রাহুলের ‘খাট-সভা’ যে এমন খাট-লুঠের ময়দান হয়ে যাবে তা বুঝি স্বপ্নেও ভাবেননি।
প্রথম ‘খাট-সভা’র জন্য আনা হয়েছিল প্রায় দু’হাজার ব্র্যান্ড-নিউ খাটিয়া। রাহুল এ দিন যাত্রা শুরু করেন ভলভো বাসে। তার পরে ‘খাট সভা’। এ পর্যন্তই ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু রাহুলের সভা শেষ হতেই খাটিয়াগুলির উপরে হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সভার লোকজন। শুরু হয় ধুন্ধুমার লুঠপাট। পুলিশ ক’জনকে ঠেকাবে! ব্যারিকেড টপকে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে দুদ্দাড় ছুটছে মানুষ। যে পাচ্ছে, যটা পারছে খাটিয়া ঘাড়ে তুলে রওনা দিচ্ছে ঘরের দিকে। বাদ যাচ্ছেন না মহিলারাও। দিনদপুরে খাটিয়া-লুটতে গ্রামবাসীদের মধ্যে তখন রেষারেষি, হাতাহাতি। লোহার তৈরি কিছু খাটও আনা ছিল মাঠে। সেগুলি ভারী। তাই সেগুলি বাদ দিয়ে বাঁশের তৈরি সবক’টি খাটিয়াই নিমেষে উধাও হয়ে যায় ময়দান থেকে।
রাহুলের সভা। সাংবাদিক, টিভির কামেরা ও ব্যুমের অভাব ছিল না। খাটিয়া মাথায় লোকজন ধরে ধরে প্রশ্ন: লুঠ করছেন কেন? বুক ফুলিয়েই সক্কলে বললেন, গরিব মানুষ, খাট নিচ্ছি। দোষটা কী?
শুধু কী খাট! রাহুলের যাত্রা-পথে লাগবে বলে কর্মীদের জন্য লাড্ডু এনে রাখা ছিল তাঁবুতে। লুঠ হয়েছে তা-ও। জলের বোতল? সেগুলিও হাতে হাতে উবে গিয়েছে কুড়ি মিনিটে।
সভায় রাহুল কী বললেন?
কে রাখে তার খবর! খাটিয়া লুঠই কার্যত লুটে নিল রাহুলের মহাযাত্রার প্রথম দিনটা। অথচ চিত্রনাট্য মেনে নরেন্দ্র মোদীকে বেঁধার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন কংগ্রেস সহসভাপতি। ভলভো বাসের সামনে ‘কৃষক যাত্রা’ তকমা সেঁটে পথচলতি সকলের হাতে বিলি করেছেন এক-একটি স্লিপ। যাতে জানতে চাওয়া হয়েছে, কে কত ঋণ মাফ চান, চাষের জমিতে কী সমস্যা। আর বলা হচ্ছে, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। খাট-পঞ্চায়েতে বসে মোদীকে নিশানা করেছেন রাহুল।
বলেছেন, ‘‘লোকসভার আগে প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের সাহায্য করার কথা বলতেন। ক্ষমতায় এসে ভুলে গিয়েছেন।’’
কিন্তু সেই সভা শেষ হতেই লুঠ-পর্বের আড়ালে চলে গেল সে সব। উত্তরপ্রদেশের প্রাক-নির্বাচনী সব সমীক্ষাই বলছে, কংগ্রেসের অবস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। প্রশান্ত কিশোরের জোরাজুরিতে ব্রাহ্মণ মুখ হিসেবে শীলা দীক্ষিতকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী করা হলেও এখনও উত্তরপ্রদেশে তিনি ‘বহিরাগত’। এই অবস্থায় রাহুলকে রাজ্যের অলিতে-গলিতে ঘুরিয়ে দলের ভোটব্যাঙ্ককে চাঙ্গা করার চেষ্টায় নেমেছে দল। এক লক্ষ একনিষ্ঠ কর্মীকেও যাত্রা পথে রাখার চেষ্টা হচ্ছে ভিড় জমাতে।
যা দেখে বিজেপি সুধাংশু ত্রিবেদীর কটাক্ষ, ‘‘৪৬ বছরের ‘তরুণ’ রাহুল গাঁধী যেন কাঁটা বিছানো খাটে বসে যাত্রা শুরু করলেন। সে কারণে মোদী সরকারের বিরুদ্ধেও আবোল-তাবোল বকছেন। এত দশক ক্ষমতায় থেকে কংগ্রেস কোন মহাকর্মটা করেছে?
এ দিনের ঘটনাটি নিয়ে বিজেপি নেতাদের বিদ্রুপ ও তাচ্ছিল্যের জবাবে মুখ খুলতে হয়েছে কংগ্রেসের জাতীয় মুখপাত্র মিম আফজলকে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিষয়টিকে খাটো করার চেষ্টা করলে গরিব গ্রামবাসীদের প্রতি অবিচার করা হবে। দেশের কিছু লোক হাজার-হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে ভেগে যাচ্ছে। আর ক’জন গ্রামের মানুষ খাটিয়ার মতো সামান্য জিনিস বাড়ি নিয়ে যেতেই আকাশ ভেঙে পড়ল! এতেই বোঝা যায় বিজেপির মানসিকতা ঠিক কেমন।’’
উত্তরপ্রদেশের পূর্ব প্রান্ত থেকে দিল্লি পর্যন্ত এক মাস ধরে প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার পথ পেরোবেন রাহুল। তার ফাঁকে ফাঁকেই ‘খাট-সভা’র আয়োজন করা হয়েছে প্রশান্ত কিশোরের প্রস্তাব মতো। দলের অন্দরে প্রশ্ন, কেমন কাটবে রাহুলের মহাযাত্রার বাকি দিনগুলি?
সভায় আনলে খাটিয়াগুলিরই বা কী হবে!
No comments:
Post a Comment